রকিবুল ইসলাম, যে চোখে একসময় ছিল দুরন্ত কৈশোরের রঙিন স্বপ্ন, সেই চোখেই এখন নেমেছে ঘন অন্ধকার। খেলতে যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হওয়া সেই কিশোর লামিম হাসান দেশের জন্য রাজপথে নেমেছিল। গত বছরের জুলাই মাসের গণ–অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে হারিয়েছে তার বাম চোখের দৃষ্টি। তবে নিভে যায়নি তার স্বপ্ন—একটি দুর্নীতিমুক্ত, সমতাপূর্ণ নতুন বাংলাদেশের।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নারগুন গ্রামের মমিনুল ইসলাম ও সাবিনা খাতুনের আদরের সন্তান লামিম। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে তার চোখে গুরুতর আঘাত লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় বন্ধুরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর থেকে চিকিৎসার জন্য দৌড়ঝাঁপ চলছে দিনাজপুর থেকে ঢাকায়, কিন্তু চোখটি আর স্বাভাবিক হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে চোখটি ছোট হয়ে যাচ্ছে এবং ব্যথা বেড়েই চলেছে।
সরেজমিনে লামিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়—ডান চোখে দৃঢ় দৃষ্টি, কিন্তু বাম চোখে লেগে আছে অশ্রুজল। শান্ত কণ্ঠে সে জানায়,
“আমার বাম চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। পানি পড়ে, ঘাম ঢুকলে প্রচণ্ড জ্বালা করে। কিন্তু কোনো আফসোস নেই—আমার তো শুধু একটি চোখ গেছে, কত ভাইকে আমরা চিরতরে হারিয়েছি। আমি তাদের জন্য দোয়া করি।”
তার কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়—
“আন্দোলনের এক বছর পার হয়েছে, কিন্তু এখনো আমরা সেই বাংলাদেশ পাইনি, যার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি এমন একটি দেশ চাই, যেখানে থাকবে না অন্যায়, দুর্নীতি বা বিভাজন। সরকার যেন আমাদের মতো আহতদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেয়—এই ত্যাগ যেন বৃথা না যায়।”
সন্তানের ত্যাগে গর্বিত বাবা মমিনুল ইসলাম বলেন,
“ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটাতে সে না বলেই গিয়েছিল। খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি ছেলের রক্তাক্ত শরীর। নিজের ভিটার জমি বন্ধক রেখে চিকিৎসা করিয়েছি। কোনো আফসোস নেই, কারণ আজ আমরা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি। ছেলের ত্যাগই আমাদের গর্ব।”
তবে চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন,
“সরকার সামান্য সহায়তা করেছিল, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। এখন আবার সমস্যা বেড়েছে। আমার ছেলে যেন বিদেশে উন্নত চিকিৎসা পায়—এই আবেদন করছি।”
লামিম একা নন—তার মতো শত শত জুলাই যোদ্ধা এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেদিনের ক্ষত। আহত যোদ্ধা মেহরাব হোসেন বলেন,
“জুলাইয়ের এক বছর পার হলেও আমরা তেমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। দেশ সংস্কারের আগে আমাদের মতো আহতদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি।”
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক ইসরাত ফারজানা জানান,
“এ পর্যন্ত জেলায় তিন শতাধিক আহত জুলাই যোদ্ধাকে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে তালিকাভুক্তির কাজ চলছে। প্রত্যেক আহত যোদ্ধার উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে এবং বাদ পড়াদের দ্রুত তালিকাভুক্ত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
Comments: