বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, আর এ নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদরাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনিশ্চিত ও হেয়ালি সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে রিজার্ভ যেখানে ছিল প্রায় ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০২৫ সালের আজকের দিনে রিজার্ভ কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ হাজার কোটি ডলারে । এই পতনের পেছনে নানা বৈশ্বিক কারণ থাকলেও, অভ্যন্তরীণ নীতির দুর্বলতা ও অস্থির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে অনেকেই মূল দায়ী হিসেবে দেখছেন।
❖ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হেয়ালি সিদ্ধান্ত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাধারণত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করতেই গঠিত হয়। কিন্তু এবারের সরকার অর্থনৈতিক নীতিমালায় হস্তক্ষেপ শুরু করায় তা নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, সরকার ‘ডলার সংকট’ মোকাবেলায় বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ না করে ব্যাংকগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করছে। এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলায় বাধা, অনলাইনে রেমিট্যান্স প্রবাহে জটিলতা এবং আমদানিতে কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে সরকার বাজারের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করছে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর পরামর্শ অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইমেজ রক্ষায় নেওয়া কিছু ‘তথাকথিত’ আর্থিক প্রণোদনা এখন রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করছে। এই ধরনের সিদ্ধান্তকে অনেকেই “হেয়ালি ও দায়িত্বহীন” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
❖ নতুন টাকা ছাপানো এবং মুদ্রাস্ফীতির শঙ্কা
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিপুল পরিমাণ নতুন টাকা ছেপেছে, তা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছে। রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে বাজেট ঘাটতি পূরণে এই পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও সূত্রে জানা গেছে।
কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
❖ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত সিদ্ধান্ত
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় একাধিক নীতিগত অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে। দেশের আমদানি-রপ্তানির বাস্তব চিত্র না জেনেই আমদানি ব্যয়ের কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, যা রপ্তানিকারক এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের ওপর সরাসরি বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
অপরদিকে, সরকারপন্থী কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে বিশেষভাবে অনুমোদিত ডলার বরাদ্দ এবং এলসি ছাড়ের অভিযোগ উঠেছে। এতে রিজার্ভের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্ন উঠেছে।
❖ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ
রিজার্ভ কমে যাওয়ার প্রভাবে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে, যার ফলে ওষুধ, জ্বালানি, কাঁচামালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এর ধাক্কা সরাসরি পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে। অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুণ, চিকিৎসা খরচ বেড়েছে, বিদেশ ভ্রমণ বা শিক্ষার খরচও বেড়েছে।
একজন চাকরিজীবী আমজাদ হোসেন জানান, “এখন বিদেশ থেকে টাকা আনাতেও ঝামেলা, আবার দামও বেশি। সরকার শুধু কথা বলছে, কাজ কিছু দেখছি না।”
❖ সমাধান কী?
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অর্থনীতি নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনমুখী সরকার হোক বা প্রশাসক সরকার, তাদের দায়িত্ব হবে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা—not নিয়ন্ত্রণ করা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে বাস্তবভিত্তিক আর্থিক নীতি গ্রহণ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাতে প্রণোদনা বাড়ানো এবং দুর্নীতিমুক্ত এলসি অনুমোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।
🔚 উপসংহার
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে। এ সময় সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত হতে হবে অত্যন্ত হিসাব-নিকাশ করে, বাস্তবভিত্তিক এবং জনকল্যাণমুখী। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যেসব সিদ্ধান্ত আমরা দেখছি, তা বরং জনমানুষের দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে, বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সরকার যদি সময় থাকতেই আত্মসমালোচনা করে বাস্তবতাকে গ্রহণ না করে, তাহলে সামনে আরও ভয়াবহ অর্থনৈতিক ঝড়ের আশঙ্কা থেকে যায়
✍ ফয়সাল আহমেদ, গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি
📅 ২৬ জুলাই ২০২৫
Comments: